জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা করতে হবে
১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম
পশু-পাখি, বন-জঙ্গল প্রভৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আত্মিক ও চিরন্তন। এতে একটা নিবিড়তা খুঁজে পাওয়া যেত। একদা মাঠে কর্মরত মানুষের পাশাপাশি পাখির দঙ্গল ছিল সাধারণ দৃশ্য। নির্দিষ্ট ধারায় চলত উভয়ের কাজ। আজ সে সুখদ পরিস্থিতি অনেকটা বিঘিœত। পরিবেশে পাখির উপস্থিতি ক্ষীয়মান।
মানুষ, প্রকৃতি ও পশু-পক্ষীর তাত্ত্বিক সম্পর্কের কথা ছাড়া জীবনের প্রয়োজনে এদের সংরক্ষণেরও প্রশ্ন আসে। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, ষোড়শ শতক থেকে ঊনিশ শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত ইউরোপের বনাঞ্চলের একটি বড় অংশ নির্মূল হয়ে যায় মানুষের উৎপাদন কর্মের বিস্তৃতি ঘটার কারণে। অন্যদিকে প্রাচীন ভারতবর্ষেও এ মর্মে একটি চিত্র আমাদের চোখে পড়ে। এ প্রেক্ষিতে সত্রাট অশোক সর্বপ্রথম বন সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং বন্যপ্রাণী শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
মানুষ ও প্রকৃতির সমন্বয়ী ধারণা সময়ের প্রবাহে অনেকখানি পরিবর্তিত হয়েছে। তবু বনপ্রাণী ও বনাঞ্চলের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব ও নান্দনিক আকর্ষণ অস্বীকার করা যাবে না। তাই প্রকৃতির দান বনাঞ্চল ও বন্য পশু-পক্ষী রক্ষার একটা বিরাট তাগিদ মানুষের মধ্যে অনুভূত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। অবশ্য ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে অনেক বনাঞ্চল মানুষের অবহেলায়। আমাদের দেশে ম্যানগ্রোভ অরণ্য চকরিয়া সুন্দরবন হারিয়ে যাওয়ার কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। ২৩ হাজার একর জুড়ে অজ¯্র বৃক্ষ লতা গুল্মাচ্ছাদিত চকরিয়া সুন্দরবন এখন নেই। এর ভৌগোলিক অবস্থান ছিল কক্সবাজার জেলার মাতামুহুরি ও মহেশখালী চ্যানেলের যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে সেখানে।
এ বনাঞ্চলের সমূলে বিনষ্টির কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে আমরা দেখি মানুষের অতি লোভ-লালসা এর জন্য দায়ী। চকরিয়া সুন্দরবনকে নিশ্চিহ্ন করে চিংড়ি ঘের এবং ঘেরকেন্দ্রিক লোকালয় গড়ে তোলার সূচনা হয় আশির দশকে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে শত শত একর জমি লিজ দেয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে চিংড়ি ঘের, যার ফলে ব্যষ্টি-সমষ্টি নয় দেশও নিঃসন্দেহে উপকৃত হয়েছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে। তবে পরিবেশ ও প্রকৃতির যে ক্ষতি হয়েছে তা সত্যি অপরিসীম এবং অপূরণীয়। বৃক্ষহীন এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে অনেক বেশি।
বন্য পশু ও পাখি সংরক্ষণের বিষয়টি সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভের খাতিরে আমাদের ধারাবাহিক আলোচনার প্রয়োজন আছে। ১৯৬৬ এবং ৬৭ সালে ‘ওয়ার্ল্ড ফান্ড ফর ন্যাচার ইন্টারন্যাশনাল’ এর একটি টিমের অভিযানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বন বিভাগের দায়িত্বে দেয়া হোক। এ সিদ্ধান্ত অনুসারে বাংলাদেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন ১৯৭৪ এর আওতায় এ নিষেধাজ্ঞায় সার্বিকভাবে দেশের বন জঙ্গলসহ বন্য পশু-পাখি বিলুপ্তির ধারা রোধ এবং অতিথি পাখির আগমনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। পশু-পাখি ও বন্য পশু সংরক্ষণের জন্য পৃথক পৃথক এলাকাও নির্ধারিত হয়েছিল। যেমন বন্য পাখি সংরক্ষণের জন্য এলাকাগুলো ভোলা ৫০২২ হেক্টর, মধুপুর ৮৪৩৬ হেক্টর, রামসাগর ৫০ হেক্টর, হাইল হাওর ১৪২৭ হেক্টর, সামান্য কিছু পাখির জন্য রেইন ফরেস্ট অঞ্চল। অন্যদিকে বন্য পশুর জন্য নির্ধারিত এলাকাসমূহ হিমছড়ি ১৭২৯ হেক্টর, চর কুকুরি মুকুরি ৪০ হেক্টর, চুনতি ৭৭৬৪ হেক্টর, পাবলাখালী ৪২০৮৭ হেক্টর, রেমন থালেংগা ১০৯৫ হেক্টর, উত্তর সুন্দরবন ৫৪৩৯ হেক্টর, দক্ষিণ সুন্দরবন ১৭৮৭৮ হেক্টর, পশ্চিম সুন্দরবন ৯০৬৯ হেক্টর, পূর্ব সুন্দরবন ১৬০৬৫ হেক্টর, রামপাহাড় ৩০২৬ হেক্টর, হাজীর খাইল ২৯০৩ হেক্টর। এছাড়া শিকারীদের জন্য উন্মুক্ত বনাঞ্চল ১১৬১৫ হেক্টর। পাখিদের জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চলে তেমন ফসল উৎপন্ন হতো না। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি ৫ মাসে উৎপন্ন ফসল অতিথি পাখিদের আহার হিসেবে নিঃশেষিত হতো এবং যে এগারটি অঞ্চল পশুদের জন্য নির্ধারিত অর্থাৎ এ অভয়ারণ্যগুলো কেবল যে অবৈধ শিকারীদের উপদ্রবে বিধ্বস্ত হচ্ছে তা নয়, বন জঙ্গলও উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
বৃক্ষ নিধন সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে ভোলার দৃষ্টান্তকে আমরা প্রতীকী হিসাবে গ্রহণ করতে পারি। ২০০১ সালে ভোলার ২৪টি ইট ভাটায় কোটি কোটি টাকার কাঠ পোড়ানো হয়েছে বছরের পর বছর।
এখন সুন্দরবনও হুমকিতে। ‘সুন্দরবনকে বাঁচান’ আজ কেবল বাংলাদেশের দাবি নয় এটি আন্তর্জাতিক শ্লোগানে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, বিশ্ব ঐতিহ্যের সাক্ষী বাংলাদেশের সুন্দরবনের অস্তিত্ব বিলুপ্তির মুখে। সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় অজ¯্র সংবাদ যথা সুন্দরবনের গাছের রোগ প্রাণী বৈচিত্র্যের বিলুপ্তি, বনজ সম্পদ ধ্বংস, বন্য প্রাণীর নির্বিচার নিধন ও চোরা শিকারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা হ্রাস ইত্যাদি খুবই গুরুত্বের সাথে প্রচার করা হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আরেক ভয়াবহ তথ্য সেটি হলো পৃথিবী ব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, যার পরিণতিতে সুন্দরবনের এক বিরাট অংশ আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সমুদ্র গর্ভে হারিয়ে যাবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা এ অতুলনীয় বনভূমির অস্তিত্বের আশংকায় চিন্তিত।
সুন্দরবনের ধ্বংসের মূল কারণের দিকে যদি দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, তাহলে দেখতে পাই এক বিরাট স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী মনে করে এ বনাঞ্চল সম্পদের উৎস। এর পেছনে সুস্পষ্ট অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে। জানা গেছে, লাখ লাখ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপার্জনের জন্য সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। তাই এক দিকে যেমন প্রণীত আইনের ভয় দেখিয়ে এ স্বার্থান্ধ লোভাতুর গোষ্ঠীকে নিরস্ত করার প্রয়াস পেতে হবে, তেমনি তাদের জন্য বিকল্প কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সুন্দরবনের ধ্বংসের অর্থ হবে ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসে জান মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। এতে সমূহ ক্ষতি হবে মানুষেরই। এখনই উপযুক্ত সময়। সুন্দরবনকে সম্পূর্ণ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পরিণত করতে হবে এবং একে কেন্দ্র করে অবৈধ কাঠের ব্যবসা, অবৈধ গোলপাতার ব্যবসা, বন্য প্রাণীর চামড়া অথবা মাংসের ব্যবসা বন্ধ করার সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যবহারিক দিকের সাথে সাথে আমরা এর সামাজিক আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে পারি না।
সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্য এখনো যতটুকু আছে তা সারা বিশ্বের পর্যটকদের আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। এ পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করলে একদিকে বন্য প্রাণী ও বনভূমি রক্ষা পাবে, অন্যদিকে একে কেন্দ্র করে অবকাঠামো গড়ে উঠবে এবং বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম স্বর্ণপদক) প্রাপ্ত।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শিবচরের পদ্মায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে গ্রেপ্তার ২
গার পাহাড় সীমান্তে শাড়ি-লেহেঙ্গা, সানগ্লাসসহ ২ কোটি ৩২ লাখ টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ
ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে টপকে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করতে যাচ্ছে ইবনে তাইমিয়া স্কুল এন্ড কলেজ
নরসিংদীতে সাদপন্থীদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ
ঈশ্বরগঞ্জে শীতার্তদের মাঝে বিএনপি নেতার কম্বল বিতরণ
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে মুচলেকা ও জরিমানার পরও বন্ধ হয়নি ইট ভাটা
ফরিদপুরের জেলার সকল অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ে গেট স্থাপনের দাবিতে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম
কুষ্টিয়ার মাটির তৈরি হাঁড়ি পাতিল যাচ্ছে বিদেশে
রাণীনগর উপজেলা পরিদর্শনে এসে শীতার্তদের শীতবস্ত্র দিলেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল
রাজশাহীর চারঘাটে আ.লীগ নেতাকে কুপিয়ে জখম
উন্নতির জন্য ক্রিকেটের বিকেন্দ্রীকরণ চান ফাহিম
দৌলতদিয়া স্রোত ও নদী ভাঙনের কারণে লোকসানের মুখে ঘাট ইজারাদার
রাজশাহীতে সাদপন্থীদের বিচার দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত
খুলনাকে গুটিয়ে জয়ে ফিরল রাজশাহী
পূর্ব থানা থেকে পালিয়ে যাওয়া ওসি শাহ আলমকে গ্রেফতারের দাবিতে উত্তরায় বিক্ষোভ
সেমি-সুয়ারেসের সঙ্গে নেইমারের জুটি নিয়ে যা বললেন মায়ামি কোচ মাসচেরানো
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলছে এবি পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচন
পরিবেশ রক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে সম্মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বান রিজওয়ানা হাসানের
মাগুরার মহম্মদপুরে ডাকাতি, একজনকে কুপিয়ে জখম
ফাইনালে গ্রিনকে পাওয়ার আশায় আস্ট্রেলিয়া